أَفَغَيْرَ اللهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلاً وَالَّذِينَ اٰتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْلَمُونَ أَنَّهُ مُنَزَّلٌ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ فَلاَ تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ- وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلاً لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ (الأنعام 114-116)-
‘(তুমি বল) তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে বিচারকরূপে কামনা করব? অথচ তিনি তোমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ। আর যাদেরকে আমরা ইতিপূর্বে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা ভালভাবেই জানে যে, এটি (কুরআন) তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে সত্যসহ নাযিল হয়েছে। অতএব তুমি অবশ্যই সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (১৪)। ‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীর পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (১৫)। ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম-মাক্কী ৬/১১৪-১৬)।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
পরপর বর্ণিত তিনটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলিক কিছু ভিত্তি ও নীতি বর্ণনা করেছেন। যেমন-
(১) যেকোন বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়ছালা দানকারী হ’লেন আল্লাহ। অতএব আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে বিধানদাতা বা বিচারক হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ নয় (কুরতুবী)।
(২) আল্লাহর কিতাব সবকিছুর বিস্তারিত ব্যাখ্যা। অর্থাৎ হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায় এবং জীবনযাপনের সকল মৌলিক বিধি-বিধান তিনি এই কিতাবে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
(৩) ইহূদী-নাছারাগণ কুরআনের সত্যতা জানা সত্ত্বেও মুখে সন্দেহ প্রকাশ করবে।
(৪) ঈমানদারগণকে অহি-র বিধানে সন্দেহ করা চলবে না।
(৫) আল্লাহর কালাম সত্য ও সুবিচার দ্বারা পূর্ণ। অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত প্রতিটি সংবাদ ও তথ্য সত্য এবং এর প্রতিটি আদেশ, নিষেধ ও বিধান ন্যায়পূর্ণ। এতে কোন ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা নেই। তাই কোন সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন নেই। রাসূল (ছাঃ)-এর সুস্পষ্ট ঘোষণা, যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন (বিদ‘আত) করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত (বুখারী হা/২৬৯৭)।
(৬) কুরআনের কোন পরিবর্তনকারী নেই। ক্বিয়ামত পর্যন্ত কেউ এর কোন একটি শব্দ বা বিধানকে রদবদল বা পরিবর্তন করতে পারবে না। আল্লাহ স্বয়ং এর সংরক্ষক।
(৭) আল্লাহর বাণী যে অপরিবর্তনীয় এবং তিনি যে সবকিছু শোনেন ও জানেন এই বিশ্বাস একজন মুমিনকে শত প্রতিকূলতার মাঝেও হকের উপর অবিচল থাকতে সাহস যোগায়।
(৮) আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান হ’ল চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত।
(৯) সংখ্যা কখনো হক ও বাতিলের মাপকাঠি নয়। অধিকাংশ মানুষ তাদের প্রবৃত্তি, অজ্ঞতা, পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই সত্য যাচাইয়ের মানদন্ড যদি আল্লাহর বাণী না হয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মতামত হয়, তাহলে ফলাফল হবে নিশ্চিত পথভ্রষ্টতা।
(১০) সত্যের অনুসারীরা সংখ্যায় কম হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে আসবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য যারা দ্বীনের সংস্কার করবে। যখন মানুষ নষ্ট হয়ে যাবে (ছহীহাহ হা/১২৭৩, রাবী ইবনু মাসঊদ (রাঃ)।
(১১) আল্লাহর বিধানের অনুসরণে সমাজের অধিকাংশ লোক বাধা হবে।
(১২) অহি-র বিধানের বিপরীতে অধিকাংশের রায় গ্রহণযোগ্য নয়।
(১৩) অধিকাংশের মতের বিরুদ্ধে অহি-র বিধানকে প্রতিষ্ঠা দানে চাই উক্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ একদল ঈমানদার মুজাহিদ।
(১৪) অহি-র বিধান দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কল্যাণবহ।
দুনিয়াতে নাস্তিকের সংখ্যা খুবই কম। বরং মুশরিকের সংখ্যাই বেশী। যারা আল্লাহকে স্বীকার করে। কিন্তু তারা আল্লাহর সাথে বা তাঁর গুণাবলী ও আইন-বিধানের সাথে অন্য কোন সত্তা ও গুণাবলী বা তার বিধানকে শরীক করে। আল্লাহ বলেন, وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ- ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ তারা শিরক করে’ (ইউসুফ-মাক্কী ১২/১০৬)। অর্থাৎ ঈমানদারগণের অধিকাংশ আল্লাহর সাথে বা তাঁর গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক করে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যারা ঈমান আনার পরেও বিভিন্ন শিরকে লিপ্ত রয়েছে, তারাও এ আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। (এ বিষয়ে হাফেয ইবনু কাছীর স্বীয় তাফসীরে অনেকগুলি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন)।
আরবের মুশরিকরা আল্লাহকে মানতো। যখন তারা হজ্জ করত তখন ‘তালবিয়া’ পাঠ করার সময় বলত,لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ- ‘আমি হাযির হে আল্লাহ তোমার কোন শরীক নেই। একজন মাত্র শরীক আছে তোমার জন্য। তুমি তার ও তার অধিকারভুক্ত সব কিছুর মালিক’। মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন মুশরিকরা তালবিয়া পাঠ করত, তখন ‘লাববায়েক লা শারীকা লাকা’ পর্যন্ত গেলেই আল্লাহর নবী (ছাঃ) তাদের বলতেন, قَدْ قَدْ ‘যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর বেড়ো না।[1]
কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর স্বীকারোক্তি তাদেরকে মুমিন বানাতে পারেনি। তাদের নাম ‘আব্দুল্লাহ’ ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব’ ছিল। কিন্তু শুধু নাম দিয়েই তারা মুসলমান হ’তে পারেনি। আজকের নামকা ওয়াস্তে মুসলমানরাও আল্লাহকে স্বীকার করে। কিন্তু জীবনের যে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চললে দুনিয়াবী স্বার্থের ক্ষতি হয়, সে সকল ক্ষেত্রে তারা তা অমান্য করে বা কৌশলে এড়িয়ে চলে। আর একারণেই তারা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যাদি বিজাতীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠাকল্পে জানমাল ব্যয় করে। কিন্তু আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। এর জন্য জান-মাল ও শ্রম ব্যয় করতে চায় না। কারণ আল্লাহর আইন সকল বান্দার জন্য সমান। সেখানে সবল, দুর্বল, সরকারী দল, বিরোধী দল কারু জন্য কোন দয়া প্রদর্শন করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে ইসলামের ফৌজদারী আইন বাহ্যত খুবই কঠোর, যা থেকে বাঁচার জন্য সমাজের প্রায় সকল অপকর্মের হোতা সমাজনেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাতে আল্লাহর আইনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ভয় পায়।
অত্র আয়াতে সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহকে প্রদান করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ঊর্ধে। অর্থাৎ দেশের জাতীয় সংসদে যদি এমন কোন আইন পাস হয়, যা আল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক, তখন রাষ্ট্র প্রধানের কর্তব্য হবে আল্লাহর আইন বলবৎ করা ও সংসদে গৃহীত আইন প্রস্তাব বাতিল করা। কেননা মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ইসলামী আইন বলবৎ করতে ধর্মীয়ভাবেই বাধ্য। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বলা হয়ে থাকে ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন সংখ্যাগরিষ্ট দলের প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর মন্ত্রী পরিষদ। রাষ্ট্রপ্রধান এখানে ক্ষমতাহীন একটি ইনস্টিটিউশন মাত্র।
এক্ষণে মুসলিম রাজনীতিকগণ যদি জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করেন, তবে তা হবে পরিষ্কারভাবে শিরক। আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত কোন বস্ত্তকে হালাল করার কোন অধিকার কোন মুসলিম সরকার বা রাষ্ট্রের নেই। অথচ বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাজনীতিকগণ দলীয় সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত সূদ-ঘুষ-জুয়া-লটারী-বেশ্যাবৃত্তি সবকিছুর অবাধ অনুমতি দিচ্ছেন। মাদক সেবন, চুরি-ডাকাতি-রাহাযানির বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর বিধান তারা জারি করছেন না। আদালতগুলিতে আল্লাহর আইনে বিচার না করে নিজেদের তৈরী আইনে বিচারের নামে অবিচার করা হচ্ছে। এভাবে আল্লাহর স্বাধীন সৃষ্টি মানুষকে তারা নিজেদের গোলাম বানিয়েছে। এগুলি আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাকে সরাসরি আঘাত করে। অতএব এই শিরকের মহাপাতক হ’তে বাঁচার জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে জিহাদী প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে আসা কর্তব্য।
ইসলামী জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুমিনকে স্রেফ আল্লাহর অহি-র অনুসরণ করতে হয়। তবে যেসব বিষয় ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, সেসব বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতে অভিজ্ঞ বিদ্বানদের নিকট থেকে পরামর্শ ও উপদেশ গ্রহণ করতে হয়। ইসলামে হারাম-হালাল, ফরয-ওয়াজিব ইত্যাদি বিষয়গুলি স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এ বিষয়গুলি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়ন করা প্রত্যেক মুমিনের ধর্মীয় দায়িত্ব। এর জন্য রাষ্ট্রপ্রধান পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হবেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ‘অধিকাংশের রায় চূড়ান্ত’। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ‘অহি-র বিধানই চূড়ান্ত’। জাতীয় সংসদে অধিকাংশের রায় যদি অহি-র বিধানের বিপরীত হয়, তবে রাষ্ট্রপ্রধান ঐ রায়ে ভেটো দিবেন ও অহি-র বিধান বলবৎ করবেন। উপরে বর্ণিত ১১৬ নং আয়াতে অধিকাংশের কথা অনুযায়ী কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে, যদি তা আল্লাহর বিধানের বিপরীত হয়।
ইসলামী শরী‘আতের সীমারেখার মধ্যে ইসলামী বিদ্বানদের অধিকাংশের মতামত ততক্ষণ গ্রহণযোগ্য হ’তে পারে, যতক্ষণ তা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুকূলে হবে। নইলে প্রত্যাখ্যাত হবে। যখনই স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখনই সকল ‘রায়’ বাতিল হবে। যদিও সেটা পার্লামেন্ট বা প্রেসিডেন্টের রায় হয়। অতএব প্রচলিত সকল বিধানকে অহি-র বিধানের অনুকূলে বাতিল বা সংশোধন করে নেওয়া সকল মুমিনের জন্য বিশেষ করে সরকারী দল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপরে ফরয দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সরকার ও জনগণকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার জন্য অবশ্যই একটি জামা‘আত বা দল থাকতে হবে। যারা উক্ত লক্ষ্যে দিনরাতের আরামকে হারাম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে এগিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে।
পরিশেষে বলব, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। মুসলমান হিসাবে আমাদের দায়িত্ব সবকিছুকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পুনর্গঠন করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!
[1]. মুসলিম হা/১১৮৪-৮৫; মিশকাত হা/২৫৫৪।