ভূমিকম্প : সতর্কবার্তা ও আত্মশুদ্ধিতার আহবান

ছোট ছোট ভূকম্পন আরও বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা। সে হিসাবে বাংলাদেশ যে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে সেটা এখন স্পষ্ট। গত ২১শে নভেম্বর শুক্রবার ১ বার ৫.৭ মাত্রার এবং ২২ তারিখ শনিবার ৩ বার সর্বমোট ৩১ ঘণ্টায় ৪ বার মাঝারি ও হালকা মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যাতে ১০ জন নিহত ও ৬ শতাধিক আহত হয়। এজন্য জনসাধারণকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য সরকারীভাবে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব যরূরী। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুর্বল ভবন-কাঠামো ও আসবাবপত্র ধ্বসে পড়ে সর্বাধিক প্রাণহানি ঘটে। তিনি বলেন, আমেরিকা ও চীনের সফল দু’টি মডেল অনুসরণ করা হ’লে ভূমিকম্প-পূর্ববর্তী ডিজিটাল অ্যালার্ট ব্যবস্থায় মানুষ তাৎক্ষণিক সতর্কতা ও প্রস্ত্ততি গ্রহণে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট এবং ব্যাপক মোবাইল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই সুবাদে কম বাজেটেই সরকার দ্রুত এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে ভূমিকম্পে রক্ষা পাবে অনেক অমূল্য জীবন।

বর্তমানে ৭ থেকে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হ’লে পুরো ঢাকা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হবে। যা আল্লাহ ‘কুন’ বললেই যে কোন সময় হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, তিনিই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাকে বলেন, হও! অতঃপর তা হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১১৭)। তিনি বলেন, ‘তোমাদের যেসব বিপদাপদ হয়, তা তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল। আর তিনি তোমাদের অনেক পাপই মার্জনা করে দেন’। ‘তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই ও সাহায্যকারী নেই’ (শূরা-মাক্কী ৪২/৩০-৩১)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না, যে পর্যন্ত না ইল্ম উঠিয়ে নেওয়া হবে। অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিৎনা প্রকাশ পাবে এবং খুন-খারাবী ব্যাপক হবে। তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, তা উপচে পড়বে’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৪১০)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘সময় সংকুচিত হয়ে আসবে’ অর্থ মাহদী আগমনের সময় নিকটবর্তী হবে (মিরক্বাত)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা ছাদাক্বা কর। কেননা তোমাদের ওপর এমন একটা যুগ আসবে যখন মানুষ তার ছাদাক্বা নিয়ে ঘুরবে। কিন্তু তা নেওয়ার মত কাউকে পাবে না। (যাকে সে দিতে চাইবে) সে বলবে, গতকাল নিয়ে আসলে আমি নিতাম। আজ আমার কোন প্রয়োজন নেই’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/১৮৬৬)। একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্বিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন, যখন আমানত বিনষ্ট হবে তখন তুমি ক্বিয়ামতের অপেক্ষা কর। লোকটি বলল, আমানত কিভাবে নষ্ট হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্য লোকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে, তখন তুমি ক্বিয়ামতের অপেক্ষা কর’ (বুখারী হা/৫৯; মিশকাত হা/৫৪৩৯)। বর্তমানে এসবের বাস্তবতা প্রকট হয়ে উঠেছে। 

মানুষ যখন নিজের ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত আর নব্য প্রযুক্তির অহংকারে মত্ত হয়ে ভুলে যায় তার প্রকৃত অবস্থান, তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে কখনো কখনো আসে মহা সতর্কবার্তা। এমনই এক এলাহী হুঁশিয়ার বাণীর নাম ভূমিকম্প। পায়ের নীচের শক্ত মাটি যখন হঠাৎ কেঁপে ওঠে, সুউচ্চ অট্টালিকাগুলো দুলতে থাকে, তখন নিমিষেই মানুষের সমস্ত দম্ভ চূর্ণ হয়ে যায়। তাই ভূমিকম্প কেবল ভূগর্ভের টেকটোনিক প্লেট সমূহের নড়াচড়া নয়; বরং এটি মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। যা আত্মভোলা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবী, এই জীবন, সবকিছুই মহান রবের হুকুমের অধীন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছ যে, আসমানে যিনি আছেন, তিনি তোমাদের সহ ভূমিকে ধসিয়ে দিবেন না? যখন তা হঠাৎ প্রকম্পিত হবে’ (মুল্ক-মাক্কী ৬৭/১৬)

ভূমিকম্পের প্রতিটি ঝাঁকুনি আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, মৃত্যুর জন্য কোন নোটিশ লাগে না, প্রস্ত্ততির সময় পাওয়া যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে (আখেরাতে) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো। যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ-মাক্কী ৩২/২১)। তিনি আরো বলেন, ‘আমি নিদর্শনসমূহ পাঠাই কেবল ভয় প্রদর্শনের জন্য’ (ইসরা ১৭/৫৯)। আজ আমরা যে হাইরাইজ বিল্ডিং আর সম্পদের বড়াই করছি, মুহূর্তেই তা আমাদের চিরস্থায়ী কবরস্থানে পরিণত হ’তে পারে। তাই এখনই সময় তওবা করার। এখনই সময় সিজদাবনত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার। আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নাফরমানী ছেড়ে দেওয়া এবং আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।

অনেক সময় আল্লাহ বিপদ আর বিপর্যয় দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। তাদের ধৈর্য, তওবা এবং ঈমানী শক্তি যাচাই করেন। তাই এ ধরনের ভূমিকম্প ঈমানদারদের জন্য আত্মসমালোচনার সুযোগ; তওবা এবং আল্লাহর রহমতের দিকে ফিরে যাওয়ার মাধ্যম। পথভ্রষ্টতা, শরী‘আতের বিধান লঙ্ঘন, উদাসীনতা, দুর্নীতি এসব কিছু সংশোধনের সুযোগ তৈরি করে এসকল আসমানী বালা-মুছীবত। এ সকল বিপর্যয়ে ভয়-আতঙ্ক, কষ্ট, ক্ষয়ক্ষতি সবই বান্দার গুনাহ মাফের কারণ হ’তে পারে, যদি সে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। তাই এ সময় অস্থিরচিত্ত না হয়ে আমাদের উচিত প্রতিনিয়ত তওবা-ইস্তিগফার করা এবং দো‘আ, ধৈর্য ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা যত বড় হয়, প্রতিদানও তত বড় হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। তাতে যে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে (আল্লাহর) সন্তুষ্টি; আর যে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে অসন্তুষ্টি (তিরমিযী, মিশকাত হা/১৫৬৬)

সর্বোপরি ভূমিকম্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই মহাপ্রলয়ের কথা, যা সম্পন্ন হবে যে কোন সময় চোখের পলকে (নাহল-মাক্কী ১৬/৭৭)। অতএব আসুন! এই ভূমিকম্প থেকে আমরা আত্মশুদ্ধিতা অর্জন করি। হতাহতদের জন্য দো‘আ করি এবং পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ে ব্রতী হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন! (স.স.)